চকচকে রৌদ্রজ্জল সাপ্তাহিক বন্ধের সকাল। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশীদের রাজধানী হিসেবে খ্যাত আনসানের ওয়া স্টেডিয়ামে চলছে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা সাউন্ড সিস্টেম চেক করে নিচ্ছেন শেষ বারের মত। আর স্টেডিয়ামের বাইরে তখন সাজ সাজ রব। চার পাশের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোতে লাগানো হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা আর বাংলাদেশের ছবি। আনসান সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে লাগানো হয়েছে এসব পোস্টার। প্রবাসী বাঙালিদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান এই বাংলাদেশ উৎসব। প্রতিবছরের মত এবারেও আয়োজন করা হয়েছে বর্নাঢ্য অনুষ্ঠান এবং ঝলমলে বিনোদনে।
সকাল আর দুপুরের সন্ধিক্ষণের বাকী বিশেষ ছিল না, তখনই পর্দা উঠল অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বের। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানকে বরণ করে নিলেন আগত দর্শকরা। পরবর্তীতে একে একে প্রদর্শিত হল প্রবাসীদের নিজস্ব প্রোগ্রাম।এরই মধ্যে আসন গ্রহণ করেছেন কোরিয়াতে নিযুক্ত মাননীয় রাস্ট্রদূত জনাব জুলফিকার রহমান। এসেছেন দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারবর্গ। শুরু হয়েছিল বৈশাখের অন্যতম জনপ্রিয় গান আইলো আইলো আইলো রে রঙ্গে ভরা বৈশাখ আবার আইলোরে’র সাথে ফ্যাশন শো’র মাধ্যমে। মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন পোষাক এবং সাজকেই তুলে ধরা হয়েছিল এর মাধ্যমে। অপরুপ বাঙালি সাজে সেজেছিলেন কোরিয়ান রমনী, নেচেছিলেন তোমার ভাঙ্গা গাড়ীতে আমি যাব না গানের সাথে।আকাশের সূর্য তখন মধ্য আকাশে, গরমের মধ্যেই দর্শকরা প্রখর কড়তালির মাধ্যমে স্বাগত জানাচ্ছেন একেকটি পারফরমেন্সকে । গান হচ্ছে, মাঝে মাঝে নাচ হচ্ছে। ততক্ষণে জমে উঠেছে মাঠের চারপাশের খাবারের স্টলগুলো।
মিষ্টি, বিরিয়ানী, ভাজা-পোড়া সাজিয়ে বসা দোকানগুলোতে ততক্ষণে দর্শকদের উপচে পড়া ভীড়। এর মধ্যে মঞ্চায়িত হল টিকাটুলির মোড়ে একটা সিনেমা হল হয়েছে গানের সাথে একঝাক তরুন তরুণীদের স্বতস্ফুর্ত নাচ। টিভিতে যেমন দর্শকরা বিরক্ত হন বিজ্ঞাপন বিরতি দেখে এখানে কিন্তু তেমনটা ছিল না। বরং খুশী হয়েছিলেন এমন নতুনত্বের জন্য। কোরিয়াবাসীডটকম পত্রিকার বিজ্ঞাপন ছিল দুটি। অনুষ্ঠানের মাঝখানে উপস্থিত সবাইকে নিয়ে র্যালীর আয়োজন করা হয়। মাননীয় রাস্ট্রদূত, দূতাবাসের সকল কর্মকর্তাদের নিয়ে র্যালীর নেতৃত্ব দেন আয়োজক কমিটির প্রধান সমন্বয়ক সাইফুল ইসলাম (ড্যানিয়েল লি)। প্রবাসী বাঙালিরা তখন গেয়ে উঠছিলেন আগে কি সুন্দর দিন কাটাইলাম, সাধের লাউ এসব গান। গল্প, কথা আর গানে প্রথম অধিবেশন তখন শেষের দিকে। জেমসের বাংলাদেশ গানের মাধ্যমে প্রথম অধিবেশনের সমাপ্তি হয়। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে শিল্পীরা তখন কাহিল অবস্থা, তবে মুখে হাসি। তাদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। গ্রীনরুমে মধ্যাহ্নভোজের সময় এসব নিয়েই মজা করছিলেন একেকজন।
আড়াইটার দিকে শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশন। বাংলাদেশ থেকে আগত কোকিলকন্ঠি গায়িকা কণা, ক্লোজআপওয়ানের মাদকতাময় কন্ঠের অধিকারী নিশিতা বড়ুয়া এবং বাংলাদেশ আইডলের মং ততক্ষণে গ্রীনরুমে চলে এসেছেন। দ্বিতীয় অধিবেশনের শুরু করলেন মং তার নিপুন মঞ্চ মাতানো পারফরম্যান্স দিয়ে। দর্শক সারি তখন তুঙ্গে। মঞ্চের চারপাশে আনন্দিত, উছ্বসিত জনতার ভীড়। একে একে পাঁচটি গান গেয়ে মঞ্চ থেকে নামলেন মং।
এরপর মঞ্চে আসলেন নিশিতা বড়ুয়া। তার নজরকাড়া বাচনভঙ্গী আর মনমাতানো অভিব্যক্তিতে এবং মাদকতাময় কন্ঠে পুরো একঘন্টা মাতিয়ে রাখলেন উপস্থিত সবাইকে। গানের মাঝে মাঝে কথা বলেন দর্শকদের সাথে। দর্শকেরাও খুশী হন প্রিয় শিল্পীর সাথে দু’দন্ড কথা বলতে পেরে।মঞ্চ মাতিয়ে এবারে স্বাগত জানালেন অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ কণাকে। মঞ্চে উঠলেন কণা। সুন্দর বাকপটুতা নির্মল চেহারা আর অসাধারণ কন্ঠে আবারও মাতালেন দর্শকদের। উত্তেজিত দর্শক এবারে নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকতে চায়। একে একে গান গেয়ে মাতালেন সবাইকে। শেষ করলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের গান দিয়ে। টি-২০ বিশ্বকাপের সময় চার ছক্কা হই হই গান গেয়ে শেষ করলেন। তবে ডুয়েট তখনো বাকী ছিল। মংএর সাথে ডুয়েট করলেন ভালবাসা ভালবাসা জিন্দাবাদ গান দিয়ে।
সকালের সূর্য ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে বিদায়ের আলো জ্বেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ উৎসব যেন সত্যিই এক টুকরো বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল সারাদিনে। শেষ বিকেলের রোদে যেন তাই কিছুটা বিষাদও লেগেছিল। অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য যারা কঠোর পরিশ্রম করেছেন তাদেরও হাসি এবং বিষাদের সম্মিলিত একটা ছাপ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত জাহিদুল ইসলাম সোহান, দিবস কান্তি দাস এবং আফসানা চৌধুরী। পরিশ্রম এবং ক্লান্তির পরও তাদের মুখে হাসির চিহ্ন বলে দিচ্ছিল দিন শেষ তারা খুশী হতে পেরেছেন। এবং ভবিষ্যতে আরও ভাল করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
আয়োজন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক সবার প্রিয় মুখ এবং সফল ব্যবসায়ী জনাব সাইফুল ইসলাম (ড্যানিয়েল লি)। যিনি সবসময় পর্দার আড়ালে থাকতেই পছন করেন কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানকে সফল করতে তিনি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন গত ছয় মাস ধরে। আয়োজক কমিটিতে আরও ছিলেন বোরহান, আওলাদ হোসেন, নাবিল হোসেন শয়ন, সানোয়ার হোসেন, নাবিক হোসেন, রাজু, সাজু এবং জসীম। সারাদিনের অক্লান্ত প্ররিশ্রম শেষে হাসি এবং ক্লান্তির রেখা ফুটে উঠেছিল তাদের মুখেও। এভাবেই শেষ হল বাংলাদেশ উৎসব ২০১৫ এর।